এম. জুলফিকার আলী ভূট্টো, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি-
মরহুম প্রফেসর খোদাবক্স মৃধা, বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় ও স্বনামধন্য ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার, খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠক। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে এ বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠান সম্প্রচারে সু-ললিত মধু মাখা কন্ঠে ধারাভাষ্য দিয়েছেন।
প্রফেসর খোদাবক্স মৃধা, ২২ জানুয়ারী ১৯৪৫ সালে রাজশাহীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে সিলেট এমসি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যাপনা দিয়ে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন। ২০০৩ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে শিক্ষকতা পেশা থেকে কর্মময় জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ধারাভাষ্যে প্রফেসর খোদাবক্স মৃধা’র অভিষেক হয়, ১৯৭২ সালে কলকাতা ইস্ট বেঙ্গল বনাম রাজশাহী জেলা ফুটবল দলের একটি প্রদর্শনী ম্যাচে, যা বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহী কেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
প্রফেসর খোদাবক্স মৃধা খেলোয়াড় হিসেবে রাজশাহী জেলা ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। রাজশাহীতে তিনি প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন “সানরাইজ স্পোর্টিং ক্লাব” নামক একটি ক্রীড়া সংগঠন।
প্রফেসর খোদাবক্স মৃধা ৩০ মার্চ, ২০১০ সালে ইহকালের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
দেশের প্রখ্যাত ও বরেণ্য ক্রীড়া ভাষ্যকার প্রফেসর খোদাবক্স মৃধার আমি একজন ভক্ত। বাংলা ধারাভাষ্যের কিংবদন্তি মরহুম খোদাবক্স মৃধা। তাকে কাছ থেকে দেখার অনেক শখ ছিলো কিন্তু দেখা হয়নি কোন দিন। কিন্তু আমি একজন বেতার শ্রোতা, দীর্ঘদিন থেকে বেতার শুনে আসছি। সেই সুবাদে মরহুম প্রফেসর খোদাবক্স মৃধার সু-ললিত কন্ঠস্বর শব্দের চিত্রের আমার নিকট খুবই পরিচিত।
ইথারের তরঙ্গে আর ভেসে আসে না “গোল নামক সোনার হরিণ দু’দলের কাছে এখনও অধরাই রয়ে গেল”
এমন অনেক নিজস্ব কথার গাঁথুনিতে বাংলা ধারাভাষ্যকে পূর্ণতা দিয়ে ক্রীড়ামোদীদের বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে কানপাততে ও চোখ রাখতে বাধ্য করতেন জনপ্রিয় ক্রীড়া ভাষ্যকার প্রয়াত প্রফেসর খোদাবক্স মৃধা।
প্রফেসর খোদাবক্স মৃধার কথা আমার মনে আছে। বাংলা ধারাভাষ্যের প্রবাদ প্রতিম পুরুষ ছিলেন, তিনি
সুমধুর কণ্ঠে সাবলীল উপস্থাপনা, বৈচিত্র্যময় পরিসংখ্যান দিয়ে যে কোনো খেলার ধারা বিবরণী লক্ষ-কোটি শ্রোতার মনি কোঠায় প্রাণবন্ত করে তোলার ক্ষমতা ছিল গুণী এই ক্রীড়া ভাষ্যকারের।
বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে শোনা “এবারে ধারাভাষ্যকারের পরিবর্তন হচ্ছে আসছেন, খোদাবক্স মৃধা” তারপরের কথামালা মনোযোগ সহকারে শুনতাম। জনপ্রিয় ক্রীড়া ভাষ্যকার খোদাবক্স মৃধা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের ক্রীড়া ভাষ্যকার, মো. জামিলুর রহমান বললেন, “ধারাভাষ্যের ইন্সটিটিউট হলেন প্রফেসর খোদাবক্স মৃধা। পেশাগত জীবনে সফল মানুষ ছিলেন। তিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীরা তার ক্লাসে উপস্থিত হতেন তার লেকচার শোনার জন্য।
ক্রীড়া ধারাভাষ্য তিনি শখের বসে করতেন। তবে একজন সংস্কৃতি মনা মানুষ হিসেবে উপস্থাপনা, সংবাদ পাঠ এবং সংগীত শিল্পী হিসেবেও তার যথেষ্ট সু-নাম ছিল, এ যেন একই অঙ্গে বহু গুণে গুণান্বিত একজন সব্যসাচী মানুষ।
খেলোয়াড়ী জীবনে তিনি রাজশাহী জেলা ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বহুদিন এবং জাতীয় লীগে অনেক সু-নামের সঙ্গে অলরাউন্ডার হিসেবে ক্রিকেট খেলেছেন। খেলোয়াড় ও শিক্ষকতা অবস্থাতেই তিনি রাজশাহীতে সানরাইজার্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে সু-নাম অর্জন করে ছিলেন।
তিনি ধারাভাষ্যে তরুণদেরকে সব সময় ওয়েলকাম করতেন এবং সুযোগ করে দিতেন। আমি নিজে তাঁর শিষ্য হিসেবে গর্ববোধ করি এবং তার দেখানো পথ অনুসরণ করে জাতীয় পর্যায়ে সু-নামের সাথে ধারাভাষ্য করছি।
ধারাভাষ্যকার খোদাবক্স মৃধাকে আমি সব সময় বলি ‘বাংলা ধারাভাষ্যের রূপকার হলেন মরহুম শ্রদ্ধেয় আব্দুল হামিদ কিন্তু শব্দ চয়ন, কন্ঠের মডিউলেশন এবং সাহিত্যের সংমিশ্রণে পরিপূর্ণতা দিয়ে ধারাভাষ্যকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন প্রয়াত প্রফেসর খোদাবক্স মৃধা।
প্রফেসর খোদাবক্স মৃধাসহ যারা বাংলা ধারাভাষ্যকে একটা শিল্পের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, যেমন আব্দুল হামিদ, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, নুর আহমেদ এবং মোহাম্মদ মুসাকে আজ শুধু নয় আমরা প্রতিনিয়তই অনুভব করি, বাংলাদেশ বেতারের বদৌলতে আজও আমি তাদেরকে মনে রাখতে পেরেছি”
“আমরা তো আর চিরদিন বেঁচে থাকবো না, আমাদের জায়গায় যদি আমরা কাউকে তৈরি করে যেতে পারি তাহলে এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে” এ রকম উক্তির রেশ টেনে আরেক বাংলাদেশ বেতারেে ক্রীড়া ভাষ্যকার, মির্জা ফরিদুল ইসলাম বলেন-মরহুম প্রফেসর খোদা বক্স মৃধা ছিলেন আপাদমস্তক একজন ক্রীড়া মনস্ক মানুষ কারণ শিক্ষকতা জীবনে তিনি সরকারি কলেজের শিক্ষক হওয়ার পরও ক্রীড়াঙ্গনের সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর ৬৫ বছর জীবনের ৩৮টি বছরই কেটেছে রেডিও আর টেলিভিশন ধারাভাষ্যে। দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। আর তার হাতে গড়া রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত সানরাইজ স্পোর্টিং ক্লাব যেন খোদাবক্স মৃধার ক্রীড়া-মননের সাক্ষী হয়ে আছে আজও।
খোদাবক্স মৃধা আমাদের দেশের একজন জনপ্রিয় স্বনামধন্য ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার ছিলেন, খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠক। তিনি অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠান সু-ললিত মধু মাখা কন্ঠে ধারাভাষ্য দিতেন। একদম ছোট বেলা থেকে সব্যসাচী এই ক্রীড়া ভাষ্যকারের ক্রীড়া ধারা বিবরণী শুনতাম। শ্রদ্ধাভাজন এই ক্রীড়া ভাষ্যকারের ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে আমি তার একনিষ্ঠ ভক্ত শ্রোতায় পরিণত হই।
ধারাভাষ্যে খোদাবক্স ছিলেন একজন পারঙ্গম ও পারদর্শী অনুকরণীয় একজন ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার। আমি তার মুখ থেকে বহুবার শুনেছি “দল জয়ের বন্দরে নোঙ্গর করতে যাচ্ছে” বেতারের সেই কথা গুলি আজও আমার কানে বাজে। বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত ক্রীড়া ভাষ্যকার সু-ললিত মধু মাখা কন্ঠে বেতারে ধারাভাষ্য দিতেন আর কান পেতে শুনতাম এই ক্রীড়া অনুরাগী, বিশিষ্ট ক্রীড়া ভাষ্যকারের তাৎক্ষণিক ঘটনার বিবরণ সম্মিলিত খেলাধুলার ধারা বর্ণনা।
এই ক্রীড়া অনুরাগী, বিশিষ্ট ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার এবং বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপক ও সংবাদ পাঠক, খোদাবক্স মৃধা সম্পর্কে বললেন এ সমযকার আরেক জনপ্রিয় ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার মো. সামসুল ইসলাম, শ্রোতাবন্ধুরা, খেলার এ পর্যায়ে ধারাভাষ্যে পরিবর্তন, মাইক্রোফোনে আসছেন-আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন ‘সামসুল ইসলাম’।
আমি বলতাম-অসংখ্য ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় খোদাবক্স মৃধা। ধারাভাষ্য কক্ষে মাইক্রোফোন চেঞ্জ ওভারের সময় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক এগিয়ে চলতো এভাবেই। বাংলাদেশে বাংলা ক্রীড়া ধারা বর্ণনার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন খোদাবক্স মৃধা। তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়ে ছিলাম বলেই, আজ ক্রীড়া ভাষ্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি। আজও তাঁর দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে চলেছি কন্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ।
গুরুর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ সেই শৈশবে, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। সেই বয়সে সাহস হয় নি, তাঁর সাথে দেখা করে, সামনাসামনি কিছু কথা বলি। বেতার ও টেলিভিশনে ক্রিকেট ম্যাচ দেখা ও ধারাভাষ্য শোনার আগ্রহ শৈশব থেকেই। টিভিতে চোখ আর বেতারে কান পেতে রাখতাম নিয়মিত।
তখনই আবিস্কার করলাম, অন্য সবার চেয়ে খোদাবক্স মৃধার ধারা বর্ণনা সম্পুর্ণ বৈচিত্রপুর্ণ। কারণ তিনি একই সাথে বল টু বল ধারাভাষ্য দিচ্ছেন, পাশাপাশি প্রকৃতি, আবহাওয়া ও খেলায় এর প্রভাব, গ্যালারী, দর্শক, নানাবিধ দূর্লভ পরিসংখ্যান উপস্থাপন, নিয়মিত ম্যাচ স্কোর আপডেট, ইত্যাদি সবই তাঁর ধারাভাষ্যে সচেতন ভাবে তুলে ধরছেন।
একজন সচেতন শ্রোতা হিসেবে আমি যা শুনতে চাই, তার সবই পাচ্ছি তাঁর ধারা বর্ণনা থেকে, উপরন্তু বাড়তি স্পাইস হিসেবে নানাবিধ উপমা-উদাহরণ, উক্তি, স্মৃতিচারণ, মোহনীয় উপস্থাপনা সব মিলিয়ে অসাধারণ। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ব্যারিটন ভয়েস, সুন্দর ও যথার্থ শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস ও তার গাঁথুনি সর্বোপরি ছন্দময় ধারা বর্ণনা এবং খেলার মৌলিক বিষয়ে ফিরে গিয়ে ম্যাচ সম্পর্কিত তথ্য ও উপাত্ত পরিবেশনের মাধ্যমে ধারাভাষ্যে তিনি তাঁর স্পেলটিকে শ্রোতা ও দর্শকদের কাছে অধিক গ্রহণ যোগ্য করে তুলতে পারতেন। আমি খুব দ্রুত তাঁর ধারা বর্ণনার প্রেমে পড়ে গেলাম। এভাবেই খোদাবক্স মৃধা হয়ে উঠেন আমার প্রিয় ক্রীড়া ভাষ্যকার এবং পরবর্তিতে গুরু।
পরিশেষে শেষ উচ্চারণ, হে আল্লাহ তুমি এই প্রিয় মানুষটাকে জান্নাত বাসী করুন আমীন। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।